শহরে যে কোন গর্ভবতী মা রে যদি ‘এপিড্যুরাল’ শব্দটা কও তাইলে কেউ ভয় পাইবো আর কেউ কইবো আমার চাই! আর সবকিছুর মত এর পক্ষে আর বিপক্ষে মতবাদ আছে। আমার চেষ্টা দুই দিক আলোচনা কইরা মাম্মালোগের কাছে ব্যাপারটা খোলাশা করা।
*** সংবিধিবদ্ধ সতর্কবানীঃ আমি ডাক্তার না, ব্যক্তিগত অভিজ্ঞ্যতা আর ইন্টারনেট আমার ভরসা, আমার উদ্দেশ্য সচেতনতা তৈরী করা। আউলা কিছু কইয়া থাকি তাইলে ডাক্তার মাম্মালোগ একটা ধমক দিয়া শুধরাইয়া দিও।***
সার্জারী (Surgery) বা অস্ত্রপোচার এর সাথে এ্যানেস্থেশিয়া (Anesthesia) ব্যাপারটা অংগাঅংগী ভাবে জড়িত। রোগী সল্য চিকিৎসার কষ্ট, ব্যথা সহ্য করার জন্য তার অংগ অবশ বা অনুভূতী শুন্য করা প্রয়োজন। এর জন্য বিভিন্ন পদ্ধতি ব্যবহার করেন ডাক্তার মাম্মারা। এইটা একটা অতি গুরুত্বপূর্ন বিষয় যার জন্য এ্যানেস্থেলিওজিস্ট (Anesthesiologist) নামের এক বিশেষ প্রশিক্ষন প্রাপ্ত ডাক্তার মাম্মারা আছে যারা শুধু রোগী মাম্মালোগ রে অজ্ঞ্যান আর জ্ঞ্যানী (!) করেন।
এ্যানেস্থেসিয়া লোকাল, রিজিওনাল ও জেনারেল হইতে পারে। ছোটখাট, কম সময় লাগে এমন অপারেশনে সাধরনত লোকাল এ্যানেস্থেসিয়া (Anesthesia) বা অভিষ্ট জায়গায়ই শুধু অনুভূতিশুন্য করা হয়, (যেমন ফোঁড়া অপারেশন, দাঁতের চিকিৎসা) জেনারেল এ্যানেস্থেসিয়ায় সারা শরীরে প্রভাব পরে তুমি অজ্ঞ্যান হইয়া যাও, তাতে অন্য জটিলতা দেখা যাইতে পারে। আর রিজিওনাল এ্যানেস্থেশিয়া র বেলায় একটা বড় এলাকার অনুভুতি শুন্য করা হয় যেমন সিজারিয়ান অপারেশনের সময় স্পাইনাল ব্লক নামের একটা পদ্ধতি নেওয়া হয়। যাতে তুমি অজ্ঞ্যান হইবা না কিন্তু কোমড় থাইকা নিচের দিকে আর কোন ব্যথা থাকবে না কয়েক ঘন্টার জন্য। এই লেখার বিষয় স্পাইনাল ব্লক (Spinal Block) বা স্পাইনাল এপিড্যুরাল (Spinal Epidural).
প্রবচন আছে প্রতিটা শিশুর জন্মের সময় মায়েরও জন্ম হয়।
শিশু জন্ম নিতে গিয়া যে ঝুঁকি আর বিপদ সংকুল পথ পার হইয়া আসে তার সমান বিপদ বা তার চাইতে বেশী ঝুঁকিপূর্ন জন্মদানকারী মায়ের থাকে। প্রসব পূর্ব ব্যাথা থাইকা প্রসবকালীন পদ্ধতিতে জন্মদানকারী মা রে একটু আরাম দেওয়ার প্রচেষ্টায় কিছু ব্যবস্থা নেওয়া হয় আজকাল তার মধ্যে একটা স্পাইনাল ব্লক (Spinal Block) যা এপিড্যুরাল (Epidural) নামেই বেশী পরিচিত।
মানুষের শিরদাঁড়া বা স্পাইনাল কলাম (Spinal Column) অনেক গুলি হাড়ের এক্টা উপরে আরেকটা সাজানো, এইগুলিতে ডিস্ক (Disk) কয় কারন তা দেখতে চাকতির মত, এইগুলির মাঝখান দিয়া আমাগো শরীরের যোগাযোগ বা কমিউনিকেশন ব্যবস্থা সব গেছে, মগজ যা সিদ্ধান্ত দেয় সেইটা এই শিরদাড়ার মাঝের স্নায়ু দিয়া শরীরের বিভিন্ন জায়গায় যায় আর সেই অংগ কাজ করে, সেইটারে স্পাইনাল কর্ড (Spinal Cord) কয়, স্পাইনাল কর্ড থাকে সুবারাকনেইড স্পেসে (Subarachnoid Space), সেরিব্রোস্পাইনাল ফ্লুইড (Cerebrospinal Fluid) দিয়া আবৃত, ডিস্কের ঠিক বাইরে জায়গাটারে এপিড্যুরাল স্পেস (Epidural Space) কয়, এইটাও এক ধরনের ফ্লুইড এ আবৃত থাকে, স্পাইনাল ব্লক এর সময় এই ডিস্কের ফাঁক দিয়া সুঁই ঢোকানো হয় এপিড্যুরাল স্পেসে নারকোটিক্স (Narcotics) , এ্যনেস্থেশিয়া (Anesthesia) সরবরাহের জন্য।
এইস্থানে এ্যানেস্থেসিয়া প্রয়োগের ফলে শরীরের নিম্নাগের অর্থাৎ তলপেট বা লোয়ার এ্যাবডোমিন, পেল্ভিস, এলাকায় ব্যাথা শুন্য কইরা অপারেশন করা যায়।
এই পদ্ধতিতে শিরদাড়ার নিচের দিকে সরাসরি শিরদাড়ার হাড়ের ফাকে ফেটানিল (Fetanyl) বুপিভ্যাক্সিন (Bupivaccine) অথার লিডোকেইন (Lidocaine) জাতীয় নারকোটিক্স অথবা এ্যনেস্থেটিক ইঞ্জেক্ট করা হয় তাতে আগামী দুই ঘন্টার জন্য তা বেদনা নাশক এর কাজ করে।
‘স্পাইনাল ব্লক’ আর ‘স্পাইনাল এপিড্যুরালে’ মিশায়া ফালায় অনেকেই, কারন দুইটার প্রয়োগ পদ্ধতি একই, দুই ক্ষেত্রেই তা শিরদাড়ার ডিস্ক বা হাড়ের ফাঁকে তরলে ইঞ্জেকশনের মাধ্যমে দেওয়া হয়। স্পাইনাল ব্লক এর বেলায় সুঁই দিয়া একবার ইঞ্জেকশনের মাধ্যমে নারকোটিক্স অথবা এ্যানেস্থেশিয়া প্রয়োগ করা হয়, আর স্পাইনাল এপিড্যুরালের ক্ষেত্রে ঐ স্থানে একটা ‘ক্যাথেটার’ (Catheter) স্থাপনা করা হয় আর তাতে অবিরাম বা যখন প্রয়োজন হয় তাতে এ্যানেস্থেসিয়া প্রয়োগ করা যায়। বার বার ইঞ্জেকশন করা লাগে না।
আজকাল স্পাইনাল ব্লকের চাইতে এপিড্যুরাল এই বেশী ব্যবহার হয় সিজারিয়ান অপারেশনের সময়, কিন্তু জটিল কোন অপারেশনের সময় স্পাইনাল ব্লক ব্যবহার করা হয়।
এপিড্যুরাল ব্লকঃ এই পদ্ধতিতে একটা ফাঁপা সুঁই এর মাধ্যমে নমনীয় সরু একটা ক্যাথেটার স্থাপন করা হয় মাঝ ও নিম্ন শিরদাড়ার মাঝা মাঝি জায়গায়, স্পাইনাল কর্ড এর আউটার মেম্ব্রেন ও স্পাইনাল কলাম এর মাঝে। প্রথমে সুঁই ঢোকানোর জায়গাটারে লোকাল এ্যনেস্থেশিয়া দিয়া অবশ কইরা নেওয়া হয় তার পরে ক্যাথেটার প্রবেশ করানো হয়। একবার স্থাপিত হইয়া গেলে সুঁই বাইর কইরা নেওয়া হয়, এখন স্থাপিত ক্যাথেটার দিয়া যখন প্রয়োজন সরাসরি এ্যানেস্থেসিয়া প্রয়োগ করা যাইব। ডাক্তার মাম্মারা ক্যাথেটারটা সিকিওর করে যাতে দরকার মত আরো অষুধ দেওয়া যায়।
স্পাইনাল ব্লকঃ অনেক্টা একই রকম তবে তাতে ক্যাথেটার স্থাপনা হয় না, ছোট সুঁই ব্যবহার হয়, তবে এই পদ্ধতিতে অষুধ স্পাইনাল কলামের ভিতরে সেরিব্রোস্পাইনাল ফ্লুইডের মধ্যে মিশাইয়া দেওয়া হয়। যেহেতু ক্যাথেটার ব্যবহার হ্য় না এই ইঞ্জেকশন প্রয়োজনানুসারে বারবার লাগতে পারে।
এককথায় দুইটার পার্থক্য হইল, স্পাইনাল ব্লকে লোকাল এ্যানেস্থেসিয়া সুবারাকনেইড স্পেসে (Subarachnoid Space) যেইখানে সেরেব্রোস্পাইনাল ফ্লুইড (Cerebrospinal Fluid) আছে তাতে মিশাইয়া দেওয়া হয়, এই সেরেবোস্পাইনাল ফ্লুইড শরীরে বর্জ্য (Waste) আর নিউট্রিয়েন্টস (Nutrients) আনা নেওয়া করে, স্পাইনাল কর্ডের কুশন হিসাবে কাম করে। অল্প পরিমান লোকাল এ্যানেস্থেটিক লাগে কারন এইটা খুব সহজেই মিশা যায়, ছোট সুঁই ব্যবহার হয় পুরা প্রসেস শেষ করতে ৫ থাইকা বিশ মিনিট লাগে।
আর স্পাইনাল এপিড্যুরাল ব্লকে রোগীরে শুইতে হয়, ক্যাথেটার স্থাপনের স্থান পরিস্কার করতে হয় বেশী লোকাল এ্যানেস্থেশিয়া লাগে কারন টিশ্যুর মাধ্যমে ছড়াইতে সময় লাগে বেশী, শিরাতেও ফ্লুইড দেওয়া লাগে। ক্যাথেটার প্রবিষ্ট করানো লাগে, পুরা প্রসেসে ১০ থাইকা ২৫মিনিট লাইগা যাইতে পারে।
স্পাইনাল ব্লক ছোট খাট, কম সময় লাগে এমন আর এপিড্যুরাল লম্বা সময় লাগে এমন সল্য চিকিৎসায় ব্যবহার হয়। স্পাইনাল ব্লকে এ্যাকশন দ্রুত আর কড়া হয় এপিড্যুরালে এ্যকশন শুরু হইতে ২০-২৫মিনিট লাগতে পারে। এপিড্যুরালে অনুভুতি থাকতে পারে কিন্তু ব্যাথা থাকে না। ক্যাথেটার লাগানো থাকায় প্রয়োজনানুসারে আরো অষুধ প্রয়োগ আর পোস্ট অপারেটিভ বা অপারেশনের পরে যদি বেদনা নাশক প্রয়োগ দরকার পরে তা সহজ হয়।
স্পাইনাল ব্লক তলপেট, পা এর অস্ত্রপোচারে আর স্পাইনাল এপিড্যুরাল গর্ভবতী মায়েদের চিকিৎসা ও ‘সি সেকশন’ বা ‘সিজাররিয়ান অপারেশন’এ ব্যবহার হয়।
যদিও সমস্যা এড়ানোর সর্বাত্মক চেষ্টা নেওয়া হয় তবুও সমস্যা দেখা যাইতে পারে, স্পাইনাল ব্লক নিলে ‘হাইপোটেনশন’ (Hypotension) বা নিম্ন রক্তচাপ হইতে পারে।
লেবার বা বাচ্চা প্রসব কালীন দ্বিতীয় স্টেজে ‘পুসিং’ দুর্বল হইতে পারে।
প্রচন্ড মাথা ব্যাথা হইতে পারে যার জন্য ‘এপিড্যুরাল ব্লাড প্যাচ’ লাগতে পারে।
‘ডিযিনেস’ (Dizziness) বা মাথা ঘোরানো লাগতে পারে।
‘প্রুরিটাস’ (Pruritus) বা চুলকানী হইতে পারে শরীরে।
যদিও কম চান্স কিন্তু খিঁচুনী (Convulsions) হইতে পারে।
নারোক্টিক্স আর “কেইন” নামীয় অষুধ ‘প্ল্যাসেন্টা’র স্তর ভেদ কইরা তাতে স্থিত শিশুর রক্তে মিশা যাইতে পারে।
শিশু জন্মের পরে বুকের দুধ পানে সমস্যা হইতে পারে।
পিঠে ব্যাথা হইতে পারে। এই অভিযোগটাই বেশী শোনা যায়, এইটা হয় যদি সুঁই ঢোকানোর সময় স্পাইনাল নার্ভ এ খোঁচা লাগে আর তাতে নার্ভ ফাইবার ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এছাড়াও খুব রেয়ার কিন্তু এইটা থাইকা ‘ইনফেকশন’ ও ‘সিইজার’ হইতে পারে।
এপিড্যুরালের বেলায় নিরাপদ ধরা হয় তবে এ্যানেস্থেশিয়া বিষয়ক জটিলতা দেখা দিতে পারে। যদি ক্যাথেটারের অগ্রভাগ কোন ব্লাড ভেসেল বা রক্তনালী ছিদ্র কইরা দেয় তাইলে এ্যানেস্থেটিক হৃদপিন্ডে যাইব, তাতে হৃদস্পন্দন বা হার্টবীটের সমস্যা থাইকা সিইজার হইতে পারে। মাথাব্যাথা হইতে পারে।
এপিড্যুরাল ব্লক এ সুবিধা বেশী, বারবার সুঁই এর খোঁচা খাওয়া লাগে না, ক্যাথেটার থাকায় দরকার হইলেই আবার এ্যানেস্থেটিক দেওয়া যায়, যদিও কন্ট্রাকশন অনুভব করবা কিন্তু ব্যাথা থাকে না, রক্তচাপ কমায়।
অসুবিধার মধ্যে প্রসেস্টা লম্বা ক্যাথেটার স্থাপনে ২০ মিনিট আর এ্যনেস্থেশিয়া র কাম শুরু করতে ২০মিনিট লাগে। প্রতি আটজন গর্ভবতী মায়ের মধ্যে ১ জনের আরেকটা পদ্ধতি লাগে, কাঁপুনী, জ্বর, চুলকানী হইতে পারে। যেহেতু কোমড় থাইকা নিচ পর্যন্ত লম্বা সময়ের জন্য অনুভুতি শুন্য বা অবশ কইরা দেয়, তাই দাঁড়াইতে বা হাটতে পারবা না অনেকটা সময়, বাথরুমে যাইতেও সাহায্য লাগবো, বাচ্চা নির্গমনের জন্য তলপেটে যে চাপ দেওয়া লাগে সেইটা দেওয়া কঠিন হইব, বাচ্চারে দুনিয়ায় আনতে ডাক্তার মাম্মার সাহায্য লাগবো (ফরসেপ যা আরো সমস্যার সৃষ্টি করতে পারে সেইটা আরেক কাহিনী)।
স্পাইনাল ব্লকে সুবিধা – সম্পূর্ন ব্যাথা মুক্ত কয়েক মিনিটের জন্য, দ্রুত প্রয়োগ করা যায়, অল্প পরিমান এ্যানেস্থেশিয়া শরীরে যায়।
অসুবিধা – প্রসিডিউরের সময় একটা অস্বস্তিকর পজিশনে থাকা লাগে, শিশুর অবস্থান আর শিরার ফ্লুইডের নিবিড় পর্যবেক্ষন করা লাগে, এপিড্যুরালের মত এইটাতেও চুলকানী, বাচ্চা নির্গমনের জন্য তলপেটে যে চাপ প্রয়োগ কতে মায়েরা তা না করতে পারা বা দূর্বল ভাবে দেওয়া, ফলে বাচ্চার ভুমিষ্ট হইতে দেরী লাগা, ফরসেপ বা বড় চিমটার ব্যবহার লাগতে পারে। ইঞ্জেকশনের জায়গায় কয়েকদিন ফোলা আর চুলকানী থাকতে পারে।
ঝুঁকি সব কিছুতেই আছে, সেইটারে মিনিমাইজ করার জন্যই ডাক্তার মাম্মারা নিরন্তর চেষ্টা কইরা যাইতাছে। আমার লেখার উদ্দেশ্য যখন তুমি এই প্রসেসে যদি যাও তাইলে জাইনা যাও এইটা আসলে কি!
নিরাপদ থাক আমার সব মাম্মালোগ!
সূত্রঃ ডাঃ নাজমা রশীদ

